বিথী (ছদ্মনাম)। বয়স আনুমানিক ২২ বছর। বাবা কাজে অক্ষম। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় তার মাথায়ই ভার পড়ে পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণের। কাজ খুঁজতে গিয়ে পড়েন দালালের হাতে।
চাকরি দেয়ার কথা বলে দালাল তাকে ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেন দৌলতদিয়ার যৌনপল্লীতে।
পল্লীতে আসার সময় কুমারী থাকলেও মাত্র ২১ দিনে ৬০ জনের মতো খদ্দেরের বিছানায় যেতে হয়েছে।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বিথী বলেন, ‘পল্লীতে আসার প্রথমে খুব কষ্ট হতো। কিন্তু আস্তে আস্তে শারীরিক ও মানসিক সেই কষ্টকে মেনে নিতে হয়েছে’।
এসময় একটি ঝুড়িতে নিজের সাজার জিনিসপত্র বের করে দেখাচ্ছিলেন বিথী। লিপস্টিকসহ নানা প্রসাধনী দেখাতে দেখাতে বিথী বলেন, ‘বেশি সাজলে খদ্দের বেশি আসে।
যে মেয়েটা দেখতে সুন্দর তার কাছে বেশি খদ্দের আসেন। আমি বেশি সাজতে পছন্দ করি না। সাধারণত একটু লিপস্টিক, একটু কাজল ও একটি টিপ পরি’।
খদ্দের ছাড়া বিথীর কাছে আর কেউই আসেন না। তার কাছে বিশ্ব মানে শুধু তার ঘর। সৌন্দর্যের জন্য নিজের ঘরটিকে চিকিমিকি ঝালরে সাজিয়ে রেখেছেন তিনি। বললেন, ‘দেখতে সুন্দর লাগে তাই সাজিয়ে রাখি। এই জায়গাটুকুতেই তো থাকতে হয়’।
রেলস্টেশন, ফেরি ও রাজধানীগামী মহাসড়কের কাছেই অবস্থিত দৌলতদিয়ার মূল অর্থনীতি চলে এই যৌন ব্যবসাকে ঘিরেই।
প্রতিদিন এই জায়গা দিয়ে যায় এক হাজারেরও বেশি ট্রাক, যাতায়াত করেন হাজার হাজার মানুষ। পল্লীটির বেশিরভাগ খদ্দেরই বাস কিংবা ট্রাক চালক।
এক ট্রাক চালক বলেন, ‘এখানে ছয়দিন ধরে আটকে আছি। এখানে আসলে প্রায়ই পল্লীতে যাওয়া হয়। একজনের কাছে সবসময় যাওয়ার চেষ্টা থাকে তবে অন্যদের কাছেও যাই’। পাশেই হাঁটাহাঁটি করছিলেন কিছু যুবক।
তারা বললেন, ‘পল্লীতে সকল বয়সের যৌনকর্মীই পাওয়া যায়। ১০ বছর থেকে ৪০ বছর বয়সী নারীদের কাছে খরচের মাত্রাটাও ভিন্ন। ৫০ থেকে শুরু করে ৫০০-১০০০ টাকা খরচ হয় তাদের কাছে যেতে’।
ট্রাক চালক কিংবা এই যুবকদের মতো প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন হাজার খদ্দের আসেন এখানে। বছরের প্রতিদিনই চলে এখানকার ব্যবসা।
তবে রাতের বেলায় ভিড়ের পরিমাণটা অনেক বেশি থাকে। দেশে মাদক নিষিদ্ধ থাকলেও এখানে গোপনে বিক্রি হয় বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য।
পল্লীতে দেখা মিলল শাহীন ও রনি নামের দুই শিশুর। তাদের জন্ম এখানেই। তাদের মা আগে এখানে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। বাবা ছিলেন এখানকারই খদ্দের।
পল্লীর বেশিরভাগ বাচ্চাই স্কুলে না গেলেও তার সন্তানরা স্কুলে যান বলে জানিয়ে শাহীন ও রনির ৩৭ বছর বয়সী মা শেফালি বিঁড়ি টানতে টানতে বলেন, আমার ছয় সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে খুশি যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করেন। ওই আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনের উৎস।
খদ্দেরের সঙ্গে খুশি যখন যৌন মিলনরত তখন হঠাৎ করেই টিনের চালে টোকা পড়ে। তার মা তখন দরজার দিকে এক বোতল পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খদ্দের পানি চাচ্ছে পান করার জন্য’।
প্রায় ১৫ সহস্রাধিক টাকা দিয়ে ভাড়া নেয়া তিন রুমের বাসার এক রুমে বসে শাহীন ও রনি বলছিল তাদের কষ্টের কথা।
রাতের বেলা গল্প ও গান শুনতে শুনতে ঘুমোতে গেলেও দিনের বেলায় বাইরে গেলেই নাকি শুনতে হয় নানা কথা। তারা বলে, “মানুষ আমাদের বলে, ‘তোদের বোন যৌন কর্ম করে। এছাড়া নানা কটু কথাও বলে তারা’।”
খদ্দের বেরিয়ে যাওয়ার পর খুশির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলেও ক্যামেরার সামনে মুখ দেখাতে নারাজ তিনি।
কারণ হিসেবে বললেন, ‘কোনো দিন যদি আমাদের সমাজের সামনে যেতে হয় তবে মানুষ চেহারা চিনে ফেলবে। তখন তারা আমাদের খুবই খারাপ নজরে দেখবে’।
১৩ বছর থেকেই যৌনকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করা খুশির নিজের কাজের প্রতি খুব একটা ঘৃণা নেই বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ছোট বেলা থেকেই এগুলো দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত। আর ছোট ভাই-বোনদেরও এতে খারাপ কিছু মনে হয় না’।
নিজে যৌনকর্মী হলেও বিশ্বাস করেন ভালোবাসায়। তবে তার কাছে ভালোবাসার মানে ভিন্ন।
বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ভাইবোনের জন্য ভালোবাসার কারণেই তো এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। মায়ের প্রতি যে টান সেটাও তো একটা ভালোবাসা। পরিবারের প্রতি যে মায়া সেটাও ভালোবাসা’।
খদ্দেরদের ভালোবাসার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, অনেক খদ্দেরই একাধিকবার আসতে চান।
তবে এখানে কোনো প্রেমিক বানাতে চাই না। কারণ এখানে প্রেমিক বানালে তারা মারধর করে সকল টাকা-পয়সা নিয়ে যায়’।
তবে খুশির ভাই শাহীন স্বপ্ন দেখে বড় হওয়ার। যৌনকর্মীদের সন্তান হওয়ায় অনেক স্কুল তাদের ভর্তি করতে না চাইলেও স্কুলের জন্য প্রায় আধা কিলোমিটার হেঁটে যায় শাহীন। ক্লাসের ফাঁকে কিছুটা কিছুটা সময়ের জন্য স্কুলের অন্য ক্লাসরুমে ছোট ভাই রনিকে দেখে আসে শাহীন।
তাদের শিক্ষকও এক সময় যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করলেও এখন একটি এনজিও’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্কুলে যৌনকর্মীদের বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন।
তিনি বলেন, ১২-১৩ বছর এ কাজ ছেড়েছি আমি।
এখন এই শিক্ষকতা করেই পরিবার চালানো ছাড়াও মেয়েকে মানুষ করছি আমি।
তবে পল্লীর মেয়েদের ভালো হওয়ার সুযোগটা কম থাকে কারণ তাদের অল্প বয়স থেকে এ কাজে যুক্ত হয় পরিবারের চাহিদার জন্য। আর ছেলেরা নষ্ট হয় নেশা করে।
এই পল্লীর মালিক ও পরিচালকদের সবাই নারী। পুরুষরা শুধু এখানকার খদ্দের। বেঁচে থাকতে যেকোনো কিছুই করতে রাজি এখানকার মেয়েরা। কার্লি নামের ৩০ বছর বয়সী এক তরুণী এখানে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছেন ১৫ বছর ধরে।
ওই সময়ে দেখতে শুকনা এবং ততোটা ভালো না থাকায় খদ্দেররা তার দিকে খুব একটা তাকাতেন না। তাই ওরাডেক্সন নামের এক ঔষধ খেয়ে নিজের স্বাস্থ্য ফেরানোর চেষ্টা করেন তিনি।
পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনরাই তাকে দিয়েছিলেন এ পরামর্শ। গরুর মোটাতাজাকরণে এ ঔষধ ব্যবহৃত হলেও এখানকার অনেক নারীই সেবন করেন স্টেরয়েড জাতীয় এ ঔষধ।
তার তিন বান্ধবী এই ঔষধ সেবনে মারা গেছেন বলে জেনেও এটা ছাড়েননি কার্লি।
এর কারণ জানাতে গিয়ে বললেন, মারা যাব নাকি বেঁচে থাকব সেই চিন্তা নেই আমার। কিছু টাকা উপার্জনই আমার মূল চিন্তা। স্রষ্টার ডাকে সাড়া দিয়েই মারা গেছেন আমার বান্ধবী। আমার সময় হলে আমিও মারা যাব।
৬৫ বছর বয়সী এখানকার এক নারী জানালেন, মৃত্যু এখানে খুব সাধারণ একটি বিষয়। আজ সকালেই জন্ম হয়েছে একটি মৃত বাচ্চার। বাচ্চাটির মরদেহ পুঁততে তার মা তো আসেননি, তার বাবার মধ্যেও এটা নিয়ে কোনো ভাবনা নেই।
১ হাজার ৫০০ যৌনকর্মীর বসবাসের এ পল্লীর নির্মমতার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল তার।